নীতি গবেষক ও ThePrint-এর কলাম লেখিকা রাধিকা পাণ্ডে প্রয়াত, বয়স হয়েছিল ৪৬ বছর।

অর্থনীতি ও নীতির জগতে এক অপূরণীয় ক্ষতি: রাধিকা পাণ্ডে প্রয়াত

অর্থনীতিবিদ, নীতি গবেষক ও ThePrint-এর কলামিস্ট রাধিকা পাণ্ডের স্মরণে তৈরি পেন্সিল স্কেচ প্রতিকৃতি।

প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ, নীতি গবেষক ও ThePrint-এর নিয়মিত কলাম লেখিকা রাধিকা পাণ্ডে ৪৬ বছর বয়সে প্রয়াত হয়েছেন। নয়াদিল্লির ILBS হাসপাতালে তিনি লিভার ফেইলিউর-এর কারণে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ২০০৮ সাল থেকে তিনি NIPFP (National Institute of Public Finance and Policy)-এ অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর হিসেবে কর্মরত ছিলেন। দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে অর্থনীতি, জননীতি এবং আর্থিক সংস্কার বিষয়ক গবেষণায় তিনি সক্রিয় ছিলেন। তাঁর জনপ্রিয় সাপ্তাহিক কলাম ও ভিডিও সিরিজ MacroSutra-র মাধ্যমে তিনি জটিল অর্থনৈতিক ও নীতিগত বিষয় সহজ ভাষায় সাধারণ মানুষের কাছে তুলে ধরতেন। ভারত সরকারের আর্থিক নীতিনির্ধারণে তাঁর গবেষণা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর মৃত্যু ভারতীয় নীতিপরিষদ ও একাডেমিক মহলে এক অপূরণীয় ক্ষতি হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে।

রাধিকা পাণ্ডের শিক্ষাজীবন: শৈশব থেকেই অর্থনীতির প্রতি অদম্য আগ্রহ

রাধিকা পাণ্ডের শৈশব ও কৈশোর সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য খুব বেশি না থাকলেও, জানা যায় তিনি ছোটবেলা থেকেই অধ্যয়নমুখী ও মেধাবী ছিলেন। তাঁর স্কুল ও কলেজজীবনে ছিল পড়াশোনার প্রতি প্রবল আগ্রহ। তিনি বারাণসী হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় (BHU) থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক (BA in Economics) ডিগ্রি লাভ করেন, যা ছিল তাঁর শিক্ষাজীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। এরপর তিনি জয় নারায়ণ ব্যাস বিশ্ববিদ্যালয় (Jai Narain Vyas University) থেকে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর (MA)পিএইচ.ডি ডিগ্রি অর্জন করেন। কৈশোর থেকেই নীতি, আর্থিক নিয়ন্ত্রণ ও অর্থনৈতিক কাঠামো বিষয়ে তাঁর আগ্রহ তাঁকে ভবিষ্যতের একজন দক্ষ অর্থনীতিবিদ ও নীতিনির্ধারক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে তোলে।

রাধিকা পাণ্ডের জীবনযাপন: এক নিরহংকারী মেধাবীর নিঃশব্দ সাধনা

অর্থনীতিবিদ ও নীতি গবেষক রাধিকা পাণ্ডের জীবনযাপন ছিল অত্যন্ত শান্ত, শৃঙ্খলাপূর্ণ ও গবেষণামুখী। পেশাগত জীবনে তিনি যেমন নিষ্ঠাবান ছিলেন, ব্যক্তিগত জীবনেও ছিলেন সহজ-সরল ও মাটির কাছাকাছি। প্রতিদিনের শুরু হতো অর্থনৈতিক সংবাদ বিশ্লেষণ ও গবেষণায়। বন্ধু ও সহকর্মীদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল আন্তরিক, কিন্তু প্রচারের আলো থেকে নিজেকে দূরেই রাখতেন। গভীর চিন্তাভাবনা, যুক্তিভিত্তিক বিশ্লেষণ ও মেধা ছিল তাঁর স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য। তিনি বাহ্যিক আড়ম্বর নয়, বরং কাজের প্রতি একাগ্রতা ও দায়িত্ববোধে বিশ্বাসী ছিলেন। তাঁর জীবনদর্শন ও জীবনযাত্রা আজকের প্রজন্মের জন্য এক নিঃশব্দ প্রেরণা।

সহকর্মীদের চোখে রাধিকা পাণ্ডে: নিষ্ঠা, মেধা ও প্রেরণার প্রতীক

রাধিকা পাণ্ডের প্রয়াণে সহকর্মী ও বন্ধুদের মধ্যে গভীর শোকের ছায়া নেমে এসেছে। ইলা পাটনায়েক, আদিত্য বিড়লা গ্রুপের প্রধান অর্থনীতিবিদ ও NIPFP-এর প্রাক্তন অধ্যাপক, বলেন, “ভারত সরকারের বহু নীতিতে রাধিকার গবেষণার স্পষ্ট প্রভাব রয়েছে। শুধু পেশাগত নয়, ব্যক্তিগতভাবেও আমি এক অমূল্য সহকর্মীকে হারালাম।” তিনি আরও বলেন, “রাধিকা ছিলেন বিরল প্রকৃতির গবেষক, যাঁর দক্ষতা আইন ও অর্থনীতি—উভয় ক্ষেত্রেই সমান গভীর। তাঁর গবেষণা শুধুমাত্র একাডেমিক ছিল না, বরং বাস্তব নীতিনির্ধারণে প্রয়োগযোগ্য।”

মন্দার কাগাড়ে, Black Dot Public Policy Advisors-এর প্রতিষ্ঠাতা বলেন, “রাধিকা ছিলেন এমন একজন, যাঁর কাছে যেকোনো আর্থিক নীতি বা জটিল প্রশ্ন নিয়ে যাওয়া যেত। তিনি ছিলেন অসাধারণ এক কমিউনিকেটর—তাঁর লেখা ও ভিডিও থেকে আমি অনেক শিখেছি।”

পাটনায়েক স্মৃতিচারণ করে আরও বলেন, “আমি যখন তাঁকে হাসপাতালে দেখতে যাই, তখন বলি, কিছুদিন বিশ্রাম নাও। কিন্তু তিনি বলেন, ‘না, আমি ভিডিও শুট করব, আমি লেখাটা শেষ করব।’ এমন কাজপাগল মানুষ আজকের দিনে খুব কম দেখা যায়।”

ভারত সরকারের নীতিনির্ধারণে রাধিকা পাণ্ডের প্রভাব

(উপশিরোনাম: ভারতীয় নীতিনির্ধারণে এক নিঃশব্দ অথচ শক্তিশালী উপস্থিতি)

অর্থনীতিবিদ রাধিকা পাণ্ডে ছিলেন এমন একজন গবেষক, যাঁর চিন্তাশক্তি ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ ভারতের একাধিক গুরুত্বপূর্ণ নীতিনির্ধারণ প্রক্রিয়ায় উল্লেখযোগ্য প্রভাব রেখেছে। ২০১৪ সালে অর্থ মন্ত্রণালয়ের Public Debt Management Agency (PDMA)-র টাস্ক ফোর্সে তিনি প্রধান সমন্বয়কারী হিসেবে কাজ করেন। তাঁর ইনফ্লেশন টার্গেটিং বিষয়ক গবেষণা পত্র পরবর্তীকালে রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার (RBI) মুদ্রানীতি কাঠামো গঠনে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।

২০১১ সালে তিনি বিচারপতি বি. এন. শ্রীকৃষ্ণের নেতৃত্বাধীন Financial Sector Legislative Reforms Commission (FSLRC)-এ গবেষণা সদস্য হিসেবে যুক্ত ছিলেন। সেইসঙ্গে প্রাক্তন আমলা ইউ. কে. সিনহা-র তত্ত্বাবধানে গঠিত Foreign Investment Working Group-এও তিনি সক্রিয়ভাবে কাজ করেন। তাঁর গবেষণায় উঠে এসেছে বন্ড মার্কেট, পাবলিক ফাইন্যান্স, CBAM ট্যাক্স এবং বিজনেস সাইকেল-এর মতো জটিল অথচ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যা ভারত সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণে বাস্তবভিত্তিক দিশা দিয়েছে।

রাধিকা শুধুই একাডেমিক গবেষক ছিলেন না—তিনি সেই বিরল ব্যক্তি, যিনি গবেষণাকে কার্যকর নীতিতে রূপান্তর করতে জানতেন। তাঁর চিন্তা ও কাজের প্রতিফলন ভারতের অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ নির্মাণে দীর্ঘস্থায়ী ছাপ রেখে যাবে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Please do not enter any spam link in the comment box.

নবীনতর পূর্বতন